ভবনা ডেস্ক:
ইলিশ নিধন, বিক্রি ও পরিবহনে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শুরু হয়েছে গত ১৩ অক্টোবর। তবে ঝালকাঠিতে দেখা যাচ্ছে এর ব্যতিক্রম। খোদ মৎস্য অফিসের যোগসাজসে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে অনেক জেলেই নদীতে মা ইলিশ ধরা অব্যাহত রেখেছেন। এদের মধ্যে মৌসুমী জেলের সংখ্যাই বেশি।
গেল এক সপ্তাহের সরেজমিন অনুসন্ধানে যা পাওয়া যায় তা হলো, শতাধিক ব্যক্তি সুগন্ধা ও বিষখালী নদীতে লক্ষাধিক মিটার জাল নিয়ে পৃথকভাবে ইলিশ নিধনের মহোৎসবে মেতেছেন, যা মধ্য রাতে দেখা যায়। অথচ নিষেধাজ্ঞার পর সপ্তাহখানেক সময় পেরিয়ে গেলেও কিছু জাল জব্দ এবং মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে দুজনকে কারাদণ্ড দেওয়া ছাড়া তেমন কোনো সাফল্য নেই মৎস্য অফিসের। তারা নামমাত্র অভিযান, ফটোসেশনসহ তাদের দাপ্তরিক আনুষ্ঠানিকতায় ব্যস্ত।
নলছিটির তেঁতুলবাড়িয়া এলাকার আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা শুরুর দিন থেকেই বিষখালী নদীর ভবানীপুর, ইসলামপুর, তেঁতুলবাড়িয়া লঞ্চঘাট ও সুগন্ধা নদীর মগড় জাঙ্গালিয়া ইটভাটা, অনুরাগ, দপদপিয়া, মাটিভাঙা এলাকায় চলছে অবাধে মা ইলিশ নিধন। অভিযানে নামার আগাম খবর পেয়ে যায় জেলেরা। এর পরই শুরু হয় মৎস্য দপ্তরের লোকদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা’।
নলছিটি উপজেলার কুলকাঠি গ্রামের জুয়েল হাওলাদার বলেন, ‘শতাধিক ডিঙি নৌকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে নদীতে। মৎস্য অফিসের অভিযানের ট্রলার আসার আগেই এরা নৌকা নিয়ে ছোট ছোট খালে আত্মগোপনে চলে যায়। অভিযানের লোকেরা চলে গেলে তারা আবার নৌকা নিয়ে নদীতে প্রবেশ করে।’ অসাধু জেলেদের সঙ্গে মৎস্য অফিসের লোকদের যোগসাজস রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন জুয়েল।
ঝালকাঠি লঞ্চঘাট এলাকার বাসিন্দা নান্টু সেলিম বলেন, ‘তালিকাভুক্ত (কার্ডধারী) অনেক জেলে নিজে নদীতে না নেমে মাছের ভাগের বিনিময়ে নৌকা ও জাল দিয়ে মৌসুমি জেলেদের সহযোগিতা করছেন। আবার এলাকার কিছু লোক নৌকা কিনে মৌসুমি জেলেদের কাছে প্রতিদিন ৩০০-৪০০ টাকায় ভাড়া দিচ্ছেন। আর মৎস্য অফিসের লোকজন সারাদিন নির্দিষ্ট একটি গণ্ডির মধ্যে ট্রলার নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, কিছু জাল ধরে ফটোসেশন করে চলে যায়।’
নদীতীরের বাসিন্দা অনেকেই জানালেন, মৎস্য অফিসের সঙ্গে যারা লিয়াজোঁ না করে, তাদেরই ধরা হয়। আর লিয়াজোঁকারীরা লুকোচুরি খেলায় দিন কাটিয়ে মা ইলিশ নিধন উৎসব করছে। জাল তোলার পর মাছ নৌকা থেকে নামিয়ে নদীর তীরের ঝোপ-জঙ্গল ও কচুরিপানার মধ্যে লুকিয়ে রাখছে। এসব ইলিশ সস্তায় কিনতে দূর-দূরন্ত থেকে ক্রেতারা আসছে প্রতিদিন।
খেয়াঘাটে দায়িত্বরত অনেকে জানালেন, পুলিশ ও ম্যাজিস্ট্রেট নদীতে অভিযানে নামলে সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল ফোনে অসাধু জেলেদের খবর জানিয়ে দেওয়ার জন্য নিয়োগ করা হয়েছে বেশ কিছু লোক। বিনিময়ে প্রত্যেককে ৫০০-৬০০ টাকা করে প্রতিদিন দেওয়া হয়। এদের কাজ হলো নদীর পাড়ে ঘুরে বেড়ানো এবং নদীতে প্রশাসন অভিযানে নামলেই মা ইলিশ নিধনকারী মৌসুমি জেলেদের সাবধান করে দেওয়া। কারণ মৎস্য কর্মকর্তা নিয়ন্ত্রণে থাকলেও জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন তাদের হিমধরা আতঙ্ক।
গণমাধ্যমে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেশ কজন জেলে জানান, বর্তমানে প্রচুর ইলিশ জালে উঠছে। দিনের চেয়ে রাতেই বেশি নিরাপদ। তাই রাতেই বেশি জাল ফেলছেন। ইলিশ বিক্রির জন্য কোনো চিন্তা করতে হয় না। ক্রেতারা নদীর তীরে বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নেন মাছ কেনার জন্য। কিছু ক্রেতা মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেন। ফোন দিলেই তারা এসে মাছ নিয়ে যান।
তবে সব অভিযোগ অস্বীকার করে এ প্রতিবেদককে জেলা মৎস্য কর্মকর্তা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘যখন যেখানে জাল ফেলার সংবাদ পাচ্ছি তখনই সেখানে অভিযান চালাচ্ছি। আমরা যেভাবে গোপন খবর পেয়ে অভিযানে ছুটে যাই, ঠিক তেমনি আমাদের অভিযানের তথ্যটিও অসাধু জেলেদের কেউ খবর দিয়ে দেয়। তাই অনেক সময় ব্যাটে বলে মেলে না। আমাদের বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ সঠিক নয়। আবার আমাদের ফোন করে ভুল তথ্যও দিচ্ছে অজ্ঞাত লোকজন। ভুল তথ্যের কারণে অভিযানেও ব্যাঘাত ঘটছে।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘৬৩ কিলোমিটার নদীর ৮ পয়েন্টে আমরা আলাদা নজর রাখছি। মৎস্য অফিসের অভিযান বা টহল টিম নির্ধারিত গণ্ডির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, পুরো এলাকায়ই টহল দেওয়া হচ্ছে। আমাদের অভিযান অব্যাহত আছে।’
0 coment rios: