বৃহস্পতিবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৪

রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি মুমিনের ভালোবাসা

 রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এর প্রতি মুমিনের ভালোবাসা


মাওঃ মুহাঃ ফজলুর রহমানঃ প্রত্যেক মুমিনের নিজের আপনজন, ধন-সম্পদ,ঘর-বাড়ি, স্ত্রী-পুত্র, পরিজন, এমনকি নিজের জীবন -এই সব কিছুর চেয়ে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি ভালবাসা বেশী হতে হবে । কুরআনুল কারীমে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেনঃ 

হে মুহাম্মদ( সঃ) ! আপনি লোকদেরকে বলে দিন, যদি তোমাদের পিতা-মাতা, তোমাদের সন্তানাদি, তোমাদের ভাই-বোন, তোমাদের স্ত্রীগণ, তোমাদের ধন-সম্পদ যা অনেক কষ্ট করে উপার্জন করেছ, তোমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য যার লোকসানকে তোমরা ভয় পাও, তোমাদের ঘর-বাড়ি যাকে তোমরা খুব পছন্দ কর- এই সব কিছুর চেয়ে আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের প্রতি ভালবাসার মাত্রা যদি বেশী না হয়, তাহলে তোমরা শাস্তির নির্দেশের অপেক্ষা কর (সূরা তাওবা-২৪) 

এই আয়াতের মর্ম অনুযায়ী সাহাবায়ে কেরাম আমল করে দেখিয়েছেন । নিজের স্ত্রী পুত্রের চেয়ে, নিজের আপনজনের চেয়ে, নিজের ধন-সম্পদের চেয়ে, নিজের ব্যবসা-বাণিজ্য এবং ঘর-বাড়ির চেয়ে, এমন কি নিজের জীবনের চেয়ে কিভাবে রাসূল (সাঃ)কে বেশী ভালবাসতে হয়, সাহাবায়ে কেরাম তা দেখিয়ে গেছেন। হযরত আবুবকর সিদ্দীক (রাঃ) তাবুকের যুদ্ধে সমস্ত মাল এনে দিয়েছেন, ঘরে একটা টাকা কড়িও রাখেননি। তাঁর মনোভাব হল রাসূল (সাঃ) চেয়েছেন, রাসূল (সাঃ)-এর জন্য আমি সব দিয়ে দিলাম। সারাটা জীবন তিনি রাসূল (সাঃ)-এর জন্য ব্যয় করেছেন । ওহুদের যুদ্ধে একবার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ল যে, রাসূল (সাঃ) শহীদ হয়ে গিয়েছেন। দ্রুত সংবাদ মদীনায় পৌঁছে গেল। মদীনা থেকে ওহুদের ময়দান তিন মাইল দূরে। একজন মহিলা মদীনা থেকে ওহুদের ময়দানের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে আর জিজ্ঞাসা করছে রাসূল (সাঃ)-এর কি অবস্থা তোমরা আমাকে বল একজন বললঃ তোমার ছেলেতো শহীদ হয়ে গেছে। সে বললঃ রাসূল (সাঃ)-এর কি অবস্থা তোমরা আমাকে বল। সে শুধু ময়দানের দিকে ছুটছে আর জিজ্ঞাসা করছে রাসূল (সাঃ)-এর কি অবস্থা আমাকে বল। আরেকজন তাকে খবর দিলঃ তোমার স্বামী শহীদ হয়ে গেছে। এতেও তার পরওয়া নেই। সে শুধু ময়দানের দিকে ছুটছে আর বলছে রাসূল (সাঃ)-এর কি অবস্থা তাই আমাকে বল। এই মহিলা সাহাবী প্রমাণ করে দিয়েছেন, তার পুত্রের চেয়ে, তার স্বামীর চেয়ে তিনি রাসুল (সাঃ) কে বেশী ভালবাসতেন । হযরত ছওবান (রাঃ) একবার রাসূল (সাঃ)-এর দরবারে হাজির হয়েছেন। তাকে খুব মলীন দেখাচ্ছিল,চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল। যেন বিরাট কোন দুশ্চিন্তা তার মাথার উপরে সওয়ার। রাসূল (সাঃ) জিজ্ঞাসা করলেন ছওবান তোমার এ অবস্থা কেন ? তিনি বললেনঃ ইয়া রাসূলাল্লাহ। আমার ভিতরে হঠাৎ চিন্তা এসে গেল যে, আপনি যখন দুনিয়া থেকে বিদায় নিবেন, তখন আপনাকে ছাড়া দুনিয়াতে আমরা কিভাবে থাকবো? আপনাকে ছাড়া এই দুনিয়াতে থাকা সম্ভব হবেনা এই চিন্তায় আমার মনের এই অবস্থা হয়েছে। তখন কুরআনের আয়াত নাযিল হলো-আল্লাহ তায়ালা বলেন  - 

যারা আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূলের আনুগত্য করে, আল্লাহ এবং আল্লাহর রাসূলকে ভালবাসে, তাদের সঙ্গে তাদের হাশর হবে। কিয়ামতের দিন তাঁরা একসঙ্গে থাকতে পারবে। তারা হলেন নবী, সত্যবাদী, শহীদ ও সৎকর্মশীলগণ। আর তারা সঙ্গী হিসেবে কতই না উত্তম । (সূরা নিসা-৬৯)

এ আয়াত শুনে সাহাবী শান্ত হলেন। এসব ঘটনা প্রমাণ করে রাসূলের প্রতি সাহাবীদের কেমন ভালবাসা ছিল। এগুলোকে শুধু ইতিহাসের ঘটনা হিসেবে পড়লে চলবে না। নিজেদের মধ্যে ঐরকম উপলব্ধি সৃষ্টি করতে হবে। সাহাবায়ে কেরামের এরকম অসংখ্য ঘটনা পাওয়া যায়, যাতে বোঝা যায় তাঁরা নিজেরদের জীবনের চেয়ে। রাসূল (সাঃ) কে বেশী ভালবাসতেন।

সাহাবায়ে কেরামের অবস্থা ছিল তাঁদের সামনে রাসূল (সাঃ) স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, তাঁদের সামনে রাসূল (সাঃ) জীবন্ত ছিলেন। রাসূল (সাঃ) কে তাঁরা ঐভাবে ভালবাসতে পেরেছেন। এখন আমরা কিভাবে রাসূল (সাঃ) কে ভালবাসব ? আমাদের সামনে রাসূল (সাঃ) স্বশরীরে উপস্থিত নেই। রাসুল (সাঃ)-এর অবর্তমানে কিভাবে তাঁকে ভালবাসতে হবে? সেটাও বহু হাদীছে রাসূল (সাঃ) বলে দিয়েছেন।

রাসূল (সাঃ)-এর অবর্তমানে তাঁকে ভালবাসার  তরীকা হলো-রাসুল (সাঃ)-এর আদর্শকে, রাসূল (সাঃ)-এর সুন্নাতকে অর্থাৎ, তাঁর তরীকাকে ভালবাসা। তাঁর তরীকাকে কেমন ভালবাসতে হবে ? নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসতে হবে। হাদীছে  এসেছে, রাসূল ( সঃ) বলেছেন,যে আমার আদর্শকে, আমার তরীকাকে, আমার সুন্নাতকে ভালবাসল, সে আমাকে ভালবাসা অর্থাৎ, আমার আদর্শকে ভালবাসাই হল আমাকে ভালবাসা। অতএব রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শকে যদি অমরা আমাদের জীবনের চেয়ে বেশী ভালবাসতে পারি, তাহলে বোঝা যাবে রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি আমার ভালবাসা আছে। এ জন্যেইতো যখন রাসুল (সাঃ)-এর কোন আদর্শকে নিয়ে সমালোচনা হয়, যেমন দাড়ী,টুপি পর্দা, কুরআন, হাদীছ বা রাসুল (সাঃ)-এর যে কোন বিষয় নিয়ে যখন সমালোচনা হয়, টিটকারী হয়,তখন খাঁটি মুমিন যে, তার ভিতরে এরকম স্পিরিট এসে যায় যে, এটার বদলা আমাকে নিতেই হবে। এটার মোকাবেলা করতে গিয়ে আমার জীবন চলে গেলেও তা করতে হবে। এটাই হল নিজের জীবনের চেয়েও (সাঃ)-এর প্রতি বেশী ভালবাসা থাকার পরিচয়। এটা হল রাসূল (সাঃ)-এর প্রতি যথার্থ ভালবাসা থাকার বহিঃপ্রকাশ। মুমিন হিসেবে আমার চেতনা হল যখন রাসূল (সাঃ)-এর আদর্শ নিয়ে তিরস্কার হবে, সেটা আমার কাছে বরদাশত হতে পারেনা। কেউ যদি আমার আপনজনকে আঘাত করে, তাহলে আমার ভিতর যতটুকু ক্রোধের সৃষ্টি হয়, যতটুকু সেটা প্রতিরোধ করার স্পৃহা সৃষ্টি হয়, রাসূলের আদর্শ নিয়ে কেউ সমালোচনা করলে, রাসুল (সাঃ) কে কেউ আঘাত করলে তার চেয়েও বেশী ক্রোধ সৃষ্টি হতে হবে, তার চেয়েও বেশী স্পৃহা আসতে হবে। এটাই হল ঈমানের পরিচয়। কারণ আমি রাসুল (সাঃ) কে এবং রাসুল (সাঃ)-এর আদর্শকে আমার আপনজন, এমনকি আমার নিজের জীবনের চেয়েও বেশী ভালবাসি।

লেখক-

মাওঃ মুহাঃ ফজলুর রহমান,

সহকারী প্রধান শিক্ষক,

পশ্চিম বানিয়াখামার দারুল কুরআন বহুমুখী মাদ্রাসা, খুলনা ।

Share on Facebook
শেয়ার করুন

Author:

Contributor of Daily Vhabna.

0 coment rios: